স্কুল জীবনের শেষ প্রান্তে জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার শেষে তোকে পরীক্ষার হলে শেষ বার দেখেছিলাম। খুব সম্ভবত মাথা নিচু করে নিজের কাগজ–কলম গোছাচ্ছিলি। চুপচাপ পাশ দিয়ে চলে গেছিলাম। তার আগের ৬ বছরে তোর সঙ্গে ৬ মিনিটও কথা বলেছি কিনা সন্দেহ! আমি পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করি নি।
তারপর বছর দশ কি বারো আগে রঞ্জন তোর ফোন নম্বর দিয়ে আমাকে প্রবল উৎসাহে দিল তোকে ফোন করবার জন্য। ওর কাছে শুনেছিলাম যে তুই কলকাতার প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার। সসংকোচে তোকে হঠাৎ ফোন করেছিলাম। আমাকে চিনতে পারার মত যথেষ্ট সময় এবং সুযোগ তোকে দিই নি। তার আগেই দূরাভাষ যন্ত্র নামিয়ে রেখেছিলাম। রঞ্জনকে বলেছিলাম যে তুই আমাকে চিনতে পারিস নি। আমি এবারও পাত্তা দেবার প্রয়োজন মনে করে নি। আর ঈশ্বর কি ভাবছিলেন সে নিয়ে মাথা ঘামাই নি।
দেখতে দেখতে বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। আমাদের সন্তান–সন্ততিরা কিছুটা বড় হয়ে গেল। প্রযুক্তির অনেক উন্নতি হল। আমরা, স্কুলের সহপাঠীরা, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এলাম। প্রত্যেকে প্রত্যেকের অস্তিত্বে অনুভব করলাম। তারই জের ধরে এবং আমাদের এক বিশেষ সহপাঠীর বদান্যতায় একদিন খুব ভোররাতে তোকে ফোন করলাম। তুই জানতিস যে ও খুব অসুস্থ। তুই সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরলি এবং এখানকার ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললি। তুই আমাকে সহজ বাংলায় বোঝালি যে সার্জারি করলেও কৃতকার্যতার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তারপর “ওকে যেতে দে” পরামর্শ দিয়ে আমাকে, জন্মের মত, যাবতীয় দ্বিধা–দ্বন্দ্বের হাত থেকে মুক্ত করে দিলি। এইরকম বলিষ্ঠ পরামর্শ দেওয়ার জন্য তোকে অনেক বছর ধরে পরিশ্রম করে যোগ্যতা অর্জন করতে হয়েছে। একদিনে হয় নি।
ও চলে যাওয়ার পর ওই মাসেই তুই একদিন ফোন করেছিলিস। সেদিন আমার ভাল লেগেছিল।
অবশেষে এই বছরের শুরুতে তুই আমার শহরে এলি এবং ওইদিন প্রায় চার ঘণ্টা ধরে আমার স্বতঃস্ফূর্ত বক বক সহ্য করলি। তোর অসাধারণ শ্রবণ দক্ষতা অনুভব করলাম। হয়তো কিছু না বলা কথাও শুনে ফেলেছিস। ও আমাকে শিখিয়েছিল মানুষের শ্রবণ ক্ষমতা থাকলেও, শ্রবণ দক্ষতা আয়ত্ব করতে হয়। সবার থাকে না।
যাইহোক, একটা চার ঘণ্টার আড্ডা হতে প্রায় চার দশক লেগে গেল। ভাগ্যিস সেদিন ধর্মঘটের জন্য আমার অফিস ছুটি ঘোষণা করেছিল!
এখন আর উপেক্ষার প্রশ্ন নেই। অন্ততঃ আমার তরফ থেকে নয়। কথা দিলাম।